এতদিন আমি জানাইনি, জানানোর উপায় ছিলো না। আমি যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলি, সেসব ক্লাস টেনের ছাত্রদের বিষয় নয়। ক্লাস টেন বয়দের কাছ থেকে এসব শোনার আশাও কেউ করেনা। এজন্যই বাধ্য হয়ে আমার গোপণ রাখতে হয়েছিলো কথাটা। সম্ভবত আমি কিছু ফেসবুকার-ব্লগারের মাথাব্যাথা করতে সক্ষম হয়েছি- দ্যাট'স হোয়াই আমাকে নিয়েও কিছু লোকে চিন্তাভাবনা করে। তার মধ্যে ব্রাত্যদা একজন। অবশ্য একদিক দিয়ে ভাবতে ভালোই লাগে, আমার মতো একটা ছেলেকে নিয়েও লোকে ভাবছে। ভালোবেসে হলেও ভাবছে, ঘৃণা করে হলেও ভাবছে। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সহজ নয়, ঘৃণা অর্জন করা আরো কঠিন। একটা সামান্য নাড়া দিতে না পারলে মানুষের ঘৃণা করার কোনো আগ্রহ জাগে না, কারণও ঘটে না। ভেবে ভালো লাগছে আমি সেই নাড়াটা দিতে পেরেছি। কিন্তু যেটা এখন ওপেন সিক্রেট, সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ নেই। অবশ্য আমার এই নিয়ে টানাটানি করার আগ্রহ ছিল না, এসব আমি কেয়ার করি না - কালও বলেছি মুনদি'কে। কিন্তু বাধ্য হয়েই টানতে হলো, ব্রাত্যদা'র অপার সুন্দর স্ট্যাটাসের (ওটার একটা স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে আমাকে একজন ফ্রেণ্ড) একটা কমেন্ট দেখে - শেখ শিপন নামের এক ভদ্রলোক লিখেছেন, "এই পরীক্ষা দেয়ার পরে ওর এফবি স্ট্যাটাসে কি পরিমাণ শব্দ যোগ হবে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।" এই কমেন্টটা না পড়লে আজ আমি সম্ভবত এই জবাবটা লিখতাম না।
অনেকেই পাঁড় নাস্তিকের ধর্ম পরীক্ষা দেয়া নিয়ে হাহা হিহি হোহো করেছেন, হাহা হিহি হোহো করার অধিকার পৃথিবীর সবারই আছে। ব্রাত্যদা'রও বলার অধিকার আছে ক্যানো তমসো ইস্লামিয়াত পরীক্ষা দিতাছে। আমার সমালোচনা করেছেন ব্রাত্যদা, তাতে আমি বিব্রত বা ক্ষুব্ধ- কোনোটাই হইনাই। আমার ক্যানো, তসলিমা নাসরিনেরও সমালোচনা করার অধিকার ব্রাত্যদা'র বাকস্বাধীনতায় পড়ে। শুধু ব্রাত্যদা'র ক্যানো, পৃথিবীর সবার বাকস্বাধীনতাতেই পড়ে। আর আমি এমন কোনো মহান বান্দাও নই যে আমার সমালোচনা করা যাবে না।
তবে সমালোচনা করার আগে আমার সম্পর্কে ব্রাত্যদা'র আরেকটু ভালো করে জেনে নেয়া উচিত ছিলো। না জেনে সমালোচনা করেছেন, তারও অধিকার আছে তাঁর। আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বলেছেন, তাতে তার অনধিকার চর্চা হয়ে যায়নি। তবে আমার কাছেই যদি তিনি তার প্রশ্নের উত্তরটা জানতে চাইতেন, হয়তো তাঁর ব্যাপারটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হতো না।
থিওলজি, যে শব্দটার মানে আমার হাতের ডিক্সনারিটা বলছে ধর্মতত্ত্ব, ব্রাত্যদা নিজেই বলেছেন "কম্পোলসারি, অতএব পরীক্ষা না দিয়ে উপায় নাই"। এই কথাটা জানার পরেও "কি করে তমসো মোহাম্মদের গুণগান গাইবে" প্রশ্নটা করা অর্থহীন। তবু তিনি করেছেন। বেশ করেছেন। প্রশ্ন করার স্বাধীনতা তার অবশ্যই আছে।
শুধু যে কথাটা তিনি জানেন না, সেটা হোলো - তিনি এমন নতুন কোনো প্রশ্ন আমাকে করেননি। এই একই প্রশ্ন প্রত্যেকটা ধর্ম ক্লাসে, প্রত্যেকটা ধর্ম পরীক্ষায় আমাকে শুনতে হয়েছে। যে স্কুলটায় আমি পড়তাম, তাতে প্রথম ঢুকেছি ২০০৭ এ। তখন আমি ক্লাস এইটের ছাত্র। ঢুকেই যেদিন আমার প্রথম ধর্ম ক্লাস পড়ল, সেদিনই আমি বলে দিয়েছিলাম আমি নাস্তিক। "নাস্তিক মানে?" ছেলেরা তেড়ে এসেছিল আমার দিকে। আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেছিলো- "তুমি আল্লাহ মানো না?
তাহলে তুমি কোত্থেকে আসছো? তোমাকে সৃষ্টি করছে কে?"- যে প্রশ্নগুলো যে কোনো নাস্তিকের জন্যই আমাদের সমাজ বেঁধে রেখেছে। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের সব নাস্তিককেই এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি একের পর এক উত্তর দিয়েছিলাম প্রশ্নগুলোর, বলেছিলাম বিজ্ঞান বলে বিবর্তনের ধারায় মানুষ আজ এই রুপে এসে পৌঁছেছে হাজার হাজার রুপের মধ্যে দিয়ে
বিবর্তিত হতে হতে। এবং যে কোনো হোমো স্যাপিয়েন্সের মতোই জৈবিক ক্রিয়ায় আমার জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর দৈহিক মিলনের ফলশ্রুতিতে আমার জন্ম হয়েছে। এই অতি সাধারণ প্রক্রিয়ায় কোনো ঈশ্বরের অংশগ্রহণ করবার প্রয়োজন হয়নি।" আমাকে ছেলেরা প্রশ্ন করেছে "মানুষ যদি বানর থেকেই মানুষ হইছে, তাইলে এখনকার বানরগুলা
মানুষ হইয়া যায় না ক্যান?" আমি বলেছি "বিবর্তন হাজার অযুত লক্ষ নিযুত কোটি বছরের একটা প্রক্রিয়া, তিরিশ চল্লিশ বছরে বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যায় না। সেজন্যই আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনকালে চোখের সামনে আমরা কোনো বানরকে মানুষ হতে দেখি না।" ছেলেগুলো আমার দিকে তেড়ে এসেছিলো, প্রায় মারতে নিয়েছিলো আমাকে। টিচার এসে আমাকে উদ্ধার করেছে।
কয়েকজনকে কান ধরে দাঁড় করিয়েও রাখা হয়েছিলো। আমার গায়ে কেউ হাত দিতে পারেনি, কিন্তু কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। ক্লাসে কান ধরে কিছু ছেলেকে দাঁড় করিয়ে টিচার যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমাকে আর কেউ আক্রমণ করেছে কি না, আর আমি যখন না বললাম; একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠলো - ওই ছেলেটা ওরে থাপ্পর দিছে। সেই টিচার "হা--ব!' বলে ধমক দিয়ে সেই ছেলেটাকে বসিয়ে দিলো। এমনিতেই মামলা পেঁচিয়ে গ্যাছে, এখন আবার নতুন আসামির বিচার করে ঝামেলা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। স্রেফ জিজ্ঞেস করার খাতিরেই আমাকে জিজ্ঞেস করা, এর বেশি আর কোনো ঝামেলা তিনি করতে চান না - বুঝলাম আমি। সেই থেকে শুরু।
এরপর প্রায় সব ধর্ম ক্লাসেই আমাকে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে জিজ্ঞেস করত- কি দীপ, তুমি না নাস্তিক, এই ক্লাসে আসছ ক্যানো? ওইখানে তো হিন্দুধর্মের ক্লাস হইতাছে, ওই ক্লাসে যাও (এই বাচ্চা পোলাপানদের কাছে নাস্তিকতা মানে হিন্দুয়ানী। অবশ্য অনেকেই আমাকেও বাচ্চা পোলাপান বলতে পারেন। তাতে আমার কিছু আসে যায় না।)!
আমি বলতাম, "আমার হাত পা বাঁধা। বাংলাদেশে যদি নাস্তিকতা পড়ানোর সিস্টেম থাকত, আমি কি পড়তাম না নাকি? যেহেতু নেই, বাধ্য হয়ে পারিবারিক ধর্ম নিয়ে আমায় পড়তে হচ্ছে।" ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করত আমায় নিয়ে। প্রায় সব ক্লাসেই আমার সাথে তর্ক বাঁধত টিচারের। এই একটা জিনিস ছিল আমার, জানি না বাংলাদেশে আর কোনো স্কুলগোয়িং বয়ের আছে কিনা, আমি টিচারদের সাথে মুখে মুখে তর্ক করতাম। বেয়াদব বলে আমার খুব নাম হয়েছিল স্কুলে। আমার বন্ধুরাও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত - "এত সাহস তুমি কোথায় পাও?"
একবারের কথা মনে পড়ে, সেটা সম্ভবত দু' হাজার নয় সাল। স্কুলে নতুন একজন টিচার এসেছে। সেই ভদ্রলোক আমাদের ইস্লামিয়াত ক্লাস নিতে শুরু করলো। তার সাথে সম্ভবত প্রথম ক্লাস সেদিন। তিনি প্রথমেই বেছে নিলেন জিহাদ, সম্ভবত সেটা লেসন প্ল্যানে ছিলো বলে। আমাদের যখন পড়াচ্ছেন জিহাদে শহীদ হলে কাকে কত কি কি পুরস্কার দিয়ে আখেরাতে খুশি করা হবে, আমি বললাম, "স্যার, তাহলে জেএমবি বাংলা ভাই হিযবুত তাহরীর- এরা নিশ্চই সব বেহেস্তে যাবে!"
তিনি বললেন- "তুমি বড্ড বেশি কথা বলো। সবচেয়ে বড় জিহাদ হলো জিহাদে আকবর, নিজের মনের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তুমি জানো?"
আমি বললাম, "সেই জিহাদে কারো শহীদ হবার সম্ভাবনা আছে কি?"
- "উফফ! তুমি বড্ড বেশি প্যাঁচাও! এসব নিয়া চিন্তা করলে তুমি তো পাগল হইয়া যাইবা!"
ঠিক সেই সময়টাতেই ঘন্টা পড়ে গ্যালো। টিফিন পিরিয়ড শুরুর ঘন্টা, ক্লাসটা টিফিনের আগে শেষ ক্লাস ছিলো, ছাত্ররা হইহই করে উঠল। তিনি পড়া বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন, সম্ভবত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
এরকম অনেক ঘটনাই তিন বছরে আমি আমার স্কুলে ঘটিয়েছি। ব্লগে-ফেসবুকে যতটা, তার থেকে কিছু কম বিতর্কিত ছিলাম না আমি আমার স্কুলে। এজন্য অনেক ঝামেলাতেও পড়তে হয়েছে। একবার তর্ক বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো, নইলে আমাকে রেড টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হবে- হুমকি দিয়েছিলেন ইংরেজীর টিচার। আবার এই তর্কের জন্যই অনেক টিচার আমাকে পছন্দও করতেন, তাদের মধ্যে অনেক ধার্মিকও ছিলেন, ছিলেন অনেক বোরকাউলী ম্যাডামও। টেস্ট পরীক্ষার সময়ও একজন বোরকাউলী ব্যাডাম বলেছিলেন, "তোমরা সবাই দেখাদেখি করে ল্যাখো। এক তমসোকেই আমি আজ পর্যন্ত দেখলাম না কারো সাথে দেখাদেখি বলাবলি করতে। ও কিন্তু নিজের আদর্শে অটু্ট থাকে।" এঁর সাথেও আমার এককালে তর্ক হয়েছে, আর তর্ক হয়েছে বলেই হয়তো আমাকে ইনিও ভালোবেসেছিলেন, আরও অনেক টিচারেরই মতো। আমার সাহসটা সবাইকেই মুগ্ধ করত (এসব আমি নিজের ঢোল পেটানোর জন্য বলছি না। যেটা সত্য, সেটা বলছি)।
আমার নাস্তিকতা নিয়ে অনেকেরই ভুরু কোঁচকানি বহাল থাকলেও এই ছাত্ররাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকত যখন দেখত অংকে ফেল করলেও ধর্মে আমার মার্ক কমপক্ষে ৮৬ এসেছে। অবশ্য সে ক্লাস এইটের ঘটনা। পরে নাইন-টেনে আর অত করে পাওয়া হয়নি আমার। তাতে আমার স্বাভাবিকভাবেই কোনো আক্ষেপ নেই।
ক্লাস এইট শেষ করার পর আমি ইচ্ছে করেই এক বছর গ্যাপ দিয়েছিলাম। এরপর আবার যখন নাইনে ভর্তি হলাম, আমার পরিবার চেয়েছিলো আমি সায়েন্স নেই। আমি জানতাম সায়েন্স নিলে আমি পারব না। কারণ সায়েন্সের অত পড়া আমার কখনোই পড়ে ওঠা হবে না (অনেকে বলতে পারে আর্টসে অনেক পরেও মার্ক পাওয়া যায় না, আর সায়েন্সে অঙ্কের মতো মার্ক ওঠে। হতে পারে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মার্ক ওঠানোর জন্য একটা মিনিমাম পড়াশোনা করা প্রয়োজন। অত পড়ার অভ্যেস আমার নেই, আমার ধাতেও সেটা সহ্য হয় না। সারাজীবনই এক রাত পড়ে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। এবার পণ করেছিলাম এসএসসি'র আগে এক মাস মন দিয়ে পড়ব। সেজন্যই নেটে আসা বন্ধ করেছিলাম। একরকম জানতাম এই পণ আমার দ্বারা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। হয়ওনি। নেট বন্ধ করে দেয়ার পর নিজেই আমি আবিষ্কার করলাম, আমি নিজের অজান্তেই অনেকদিন পর টিভিটা খুলছি। বাসায় তিনটা টিভি আছে। খাবার ঘরে একটা, আমার ছোট ভাইয়ের ঘরে একটা, আমার বাবামা'র ঘরে একটা। শেষটাই সবচেয়ে বড়ো, সেটাই বেছে নিলাম আমি। বাবা মা বাধ্য হয়ে ছোট ভাইয়ের ঘরে ঘুমোতে লাগল। সারারাত জেগে জেগে টিভি দেখেছি আমি। পুরো জানুয়ারি মাসটা কাটিয়েছি তারা মিউজিক, এইচবিও, জি স্টুডিও দেখে। ফেব্রুয়ারিতে যখন পরীক্ষা শুরু হলো, প্রথম পরীক্ষা বাংলা প্রথম পত্রের আগের দিন আমি নিজের তাড়নাতেই সারাদিন্ পড়লাম। কিন্তু ওই একবারই। অন্য পরীক্ষাগুলোর বেলায় তা-ও করা হয়নি। ঠিকই আমি ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে টিভি দেখেছি। বাবা মা তাদের বেডরুম থেকে নিস্ক্রান্ত হলো, এখনও নিস্ক্রান্তই আছে। আমাকে কিছু বলার সাহস এ বাড়ির কারও নেই। কারণ জানে কিছু বলেই কিছু হবে না। আমাকে কেটে ফেললেও আমার স্বভাব পাল্টাবে না। অগত্যা তারা মুখ বুজে থাকে।
তারা মিউজিকের দিনভর রবীন্দ্রসংগীতের কল্যাণে আমার বেশিরভাগ পরীক্ষাই খারাপ হয়েছে। কয়েকটাতে পঞ্চাশের বেশি পাবো না। তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। একটা যেনোতেনো রেজাল্ট হলেই আমার চলবে। আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা, জিপিএ ফাইভ পাওয়া নিয়ে নয়। পরিবার বা স্কুলও আমার কাছ থেকে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু আশা করে না। কারণ তারা জানে আমার যোগ্যতা থাকলেও জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্য যে মিনিমাম এফোর্টটা দিতে হয়, সেটা আমি দেবো না। পড়াশোনা আমি বেশ কয়েকবার বাদ দিয়েছিলাম। এ নিয়ে অনেক সামাজিক পারিবারিক দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, হেনস্থা হতে হয়েছে। আমি গায়ে মাখিনি। ইচ্ছে তো ছিল পড়াশোনা আর করবই না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে করছি, তার কারণ একটাই- না করলে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে। করলেও দেয়া হবে, সেরকমই চুক্তি আছে আমার সাথে আমার বাবা-মা'র- তবে যদি পড়াশোনাটা চালিয়ে যাই, তাহলে বেরটা করা হবে আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর। অর্থাৎ, আরও অন্তত পাঁচ-ছ'টা বছর আমি এই ঠাঁইয়েই থাকতে পারব। আমার কিছু করার নেই বলেই বাধ্য হয়ে আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। শুনেছি ইয়োরোপ আমেরিকায় এক সামার ভ্যাকেশানে ছেলেমেয়েরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে থালাবাসন মাজে। তাতেই যা টাকা পায় তা-ই দিয়ে পরের সামার ভ্যাকেশানে একা একা বেরিয়ে পড়ে পৃথিবী দেখতে। আমাদের দেশে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই, নইলে আমিও তা-ই করতাম। টাকাপয়সা ইনকাম করার কোনো উপায়ই এ দেশে একটা আঠারো বছরের ছেলের নেই, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে পড়াশোনাটাই করতে হচ্ছে।
বলছিলাম যে সায়েন্স আমি নিইনি। সায়েন্স নেয়ার প্রস্তাব যখন নাকচ করে দিলাম, তখন আমাকে ফ্যামিলি-স্কুল দু'খান থেকেই বলা হোলো, বেশ, তাহলে কমার্স নাও। আমি তাতেও না বললাম। কারণ কমার্সে যেসব পড়ানো হয়, সেসব পুঁজিবাদী সমাজের অংশ। তাতে আমি বিশ্বাস করি না। ঠিক যে কারণে নাস্তিক হয়েও আমাকে ধর্ম পরীক্ষা দিতে হয়, সে কারণেই পুঁজিবাদে বিশ্বাস না করেও আমাকে পুঁজিবাদী জীবনই যাপন করতে হয়। সমাজটাকে আমি একা একা পালটে দিতে পারি না। সমাজকে একা পাল্টানোর ক্ষমতা আমি ক্যানো, তসলিমা নাসরিন অথবা হুমায়ুন আজাদেরও ছিল না। কিন্তু এটুকু তো আমি করতেই পারি। তাই কমার্সে পড়ার প্রস্তাবও আমি নাকচ করে দিলাম, স্কুলের হেডমাস্টার অনুরোধ করার পরেও। তিনি বললেন- "তুমি এটাকে এভাবে নিচ্ছো ক্যানো? তুমি বরং মনে করো না, একটা জিনিস নিয়ে তুমি জানছ, পড়াশোনা করছ। যেটা জানছ, সেটা যে মানতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তুমি এটাকে সেভাবেই নাও।" আমি বললাম - "না"। একইভাবে আর্টসেও অর্থনীতিটা নিইনি আমি, একই কারণে। নিয়েছি পৌরনীতি।
নাইনে ইসলাম ধর্মও আমি নিতে চাইনি। জানতে চেয়েছিলাম হিন্দুধর্ম নেয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা, কারণ ছোটবেলায় হিন্দুধর্ম নিয়ে আমি অনেক পড়েছি। এটা নিলে এতে আমি ভালোও যেমন করব, তেমন পারিবারিক দাবিটাকেও পায়ে দলতে পারব। কিন্তু এখন আর সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। এককালে আমাদের দেশের মুসলিম ছেলেরা হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম সবই পড়তে পারত। এখন সে চল উঠে গ্যাছে। বাধ্য হয়েই আমাকে ইসলাম ধর্ম নিতে হলো।
এরপর প্রত্যেকটা ধর্ম পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা এ নিয়ে হাসাহাসি করত। কখনো কখনো তাতে টিচারেরাও যোগ দিতেন। আমাদের স্কুলের দিবা শাখার শিফট-ইন-চার্জ ছিলেন নিপা নামে এক মহিলা। আমি তাকে পছন্দই করতাম। কারণ, অন্য দশটা মেয়ের তুলনায় তিনি বেশ কিছুটা আধুনিক। সারাক্ষণ ক্লাউনের মতো আচরণ করেন। একটা স্কুলের শিফট-ইন-চার্জ হয়ে সেই ক্লাউনের মতো আচরণ করতেও যথেষ্ট সাহস দরকার। তাঁর কথাবার্তাও অত্যন্ত ধারালো। সেই ধারালো কথাবার্তার ধারে আমাকেও অনেকবার অপমানিত হতে হয়েছে, তবুও আমি তাঁকে তাঁর সাহসের জন্য সবসময়ই পছন্দ করে গ্যাছি। কখনো দেখতাম, ক্লাসে ঢুকেই হাত আদ্যিকালের বাঈজীদের মতো নাচিয়ে "হাই মাসুদ, ক্লাস কেমন চলছে" বলে স্যারকে ডেকে নিচ্ছেন - অনেকেই বলাবলি করত এসব স্যারের সাথে নাকি তাঁর প্রেম আছে। থাকতেই পারে প্রেম, যদিও জানি নেই। আমার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। কখনো দেখতাম, বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি হাতের চাবিটা ওপরে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন, তারপর এক পাক নেচে আবার ধরে ফেললেন। ছাত্ররা তো বটেই, অনেক গার্জিয়ানও ক্ষ্যাপা ছিলো নিপা ম্যাডামের ওপর। অনেকেই তাঁকে আড়ালে আবডালে "বেশ্যা" বলত, এখনও বলে। একজন গার্জিয়ান একবার পণ করেছিলো "নিপাকে ন্যাংটা করে রাস্তায় ছেড়ে দেবে।" এখনও অনেকেরই এ ধরনের সংকল্প রয়েছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এসবের কারণ, তিনি যতই ভাঁড়ামো করুন, শাসনটা তাঁর মাত্রাতিরিক্ত কঠোর। সেটাকে কখনোই আমি সমর্থন করিনি, কিন্তু ওই যে বললাম, একা একা আমি সিস্টেম পাল্টাতে পারি না - তাই কখনো কখনো আমাকেও সে শাসনের শিকার হতে হয়েছে।
দু'হাজার নয় সালের কথা। একদিন ক্লাস শেষে যখন বেরিয়ে যাচ্ছি স্কুল থেকে, দেখি তিনি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে।
আমি বললাম, "নমস্কার।" (এই নমস্কার নিয়েও অনেকে আপত্তি করতে পারেন, বলতে পারেন নাস্তিক হয়ে আমি কেনো নমস্কার বললাম। এ নিয়ে আবার নতুন করে ভুল বোঝাবোঝি হোক, তা আমি চাই না। তাই এ ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার। এই নমস্কারটা আমি দিই, তার প্রথম কারণ- শব্দটা আমাদের সংস্কৃতিরই। আরবি-ফারসি নয়। দ্বিতীয় কারণ, নমস্কারটাকে আমি ব্যবহার করি মানুষের মানসিকতা বোঝার মাপকাঠি হিসেবে। নমস্কার কথাটা উচ্চারণ করার পর লক্ষ্য করি কে ক্যামন প্রতিক্রিয়া করে। কার প্রতিক্রিয়া ক্যামন তার ভিত্তিতে আমি তাদের নিজের মতো করে রেটিং দেই।
রেটিং ১- এই দলের লোকেরা নমস্কারের উত্তরে স্রেফ একটু মাথা ঝোঁকায়, সালামের উত্তরেও তারা তাই করে। এদের সাধারণত কে নমস্কার দিলো কে সালাম দিলো তা নিয়ে মাথাব্যাথা থাকে না। এদের ফেলা যায় সুস্থ শ্রেণীতে।
রেটিং ২- এরা নমস্কারের উত্তরে সাধারণত হাসে। এবং যেটা ভাবে, সেটা এরকম- ছেলেটা একটু অন্যরকম, আর দশটা ছেলের মতো নয়। ওর আচরণ একটু অন্যরকম হতেই পারে, এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এদের চিন্তাধারাও যথেষ্ট সুস্থ।
রেটিং ৩- এরা নমস্কার পেলে মুখ কালো করে ফেলে। ছেলেটা মুসলমানের ছেলে হয়ে নমস্কার দিচ্ছে, প্রত্যুত্তরে তাকে তারা একটা থাপপড় কষিয়ে দিতে পারছে না - যেহেতু ছেলেটা সরকারি কর্মকর্তার ঔরসজাত, এবং ছেলেটা না চাইলেও তার বাবা ঠিকই ক্ষমতা খাটায় - সেটা ছেলে যতই অপছন্দ করুক। এই তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যরা মোটামুটি ব্যাকডেটেড, বেশিরভাগ সময়েই নির্বোধ।
রেটিং ৪- এরা ভাবে ছেলেটা পাগল, তাই কিছু বলে না। এদেরকে আমায় পছন্দ করেন এমন অনেক টিচারই পাগল বলতেন, বলতেন - ওরা নিজেরাই পাগল। এই দলে অনেক ধার্মিক শিক্ষকও ছিলেন।
রেটিং ৫- এরা রীতিমত তেড়ে আসে, "মুসলমানের ছেলে হয় সালাম দিবা না হয় গুড মর্নিং বলবা না হয় বলবা সুপ্রভাত। নমস্কার দিবা ক্যানো?" এরা সম্পূর্ণ ধর্মান্ধ।
এছাড়া আরও অনেকেই আরও অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া করত। তবে এই প্রতিক্রিয়াগুলোই বেশি পেতাম। এখনও পাই।
১ ও ২ নং ছাড়া বাকি দলগুলোকে আমি মোটামুটি পাশ কাটিয়ে চলতাম। আমার নিজেরই এতে সুবিধে হত। এখনও হয়।)
সেদিন নিপা ম্যাডাম আমার "নমস্কার" শুনে বললেন - এই যে নমঃবাবা, এদিকে এসো।
আমি ওনার নির্দেশিত দিকে গেলাম।
- নখ দেখাও!
আমি সেদিনই নখ কেটেছি, হাতে নখ ছিল না। নির্ভয়ে দু'হাত মেলে ধরলাম।
তিনি বেছে বেছে আমার একটা আঙুল বের করলেন, আঙুলের কোণায় একটু নখ রয়ে গেছে। অতি অল্প, দৈর্ঘ্যে দুই মিলিমিটার, প্রস্থে তিন। সেটাই তাঁর কাটতে হবে। আমি বললাম, "আপা, নখটা কাইটেন না, রক্ত বেরোবে।"
- "বেরোক, একটু রক্ত বেরোলে এমন কিছু এসে যায় না। শরীরে প্রচুর রক্ত আছে, তার মধ্যে কয়েক ফোঁটা বেরোলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না।"
তিনি স্কুলের পিয়নকে পাঠালেন অফিসঘর থেকে ব্লেড আনতে। ব্লেড নিয়ে। স্কুলের বুয়াকে পাঠালেন ব্লেড কিনিয়ে আনতে। বুয়া নাচতে নাচতে ব্লেড কিনতে গ্যালো, কিছুক্ষণ পর নিয়ে ফিরেও এলো। যা ভেবেছিলাম, তাই হোলো। রক্ত সত্যিই বেরুলো। যখন আমাকে ছেড়ে দেয়া হল, আমি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলাম। বেরোনোর সময় লক্ষ করলাম, দারোয়ান অমল মিটিমিটি হাসছে। কেন হাসছে তা আমার জানা আছে। আমাকে এতদিন কেউ বাগে পায়নি, কোনো টিচার গায়ে হাত তুলতে সাহস করেনি - পাছে আমি উলটো মেরে বসি। অবশ্য তার থেকে বড় কারণ এবং আসল কারণ আমার সরকারি কর্মকর্তা বাবা। সে ভালো করেই বলে দিয়েছে স্কুলের টিচারদের, "ছেলে আমার একটু পাগলা টাইপের। ওকে একটু দেখে রাইখেন। গায়ে হাত টাত দিবেন না কিন্তু। তাইলে কিন্তু ও স্কুল ছেড়ে দিবে। আর একবার ছেড়ে দিলে ওরে ফিরাব, সেই সাধ্য আমার নাই।" দারোয়ান আমল হাসছে, কারণ শেষ পর্যন্ত আমাকে কেউ একজন পাকড়াও করতে পেরেছে। এতে অমলের মস্তিস্কে এক বিকৃত আনন্দের জন্ম হয়েছে। সেই আনন্দেই সে দাঁত কিটমিট করে হাসছে।
সেদিন আমি সত্যিই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ স্কুলে আর পড়ব না।
মাস দেড়েক পরে হেডমাস্টার আমাকে ফোন করলেন।
- "তমসো, তুমি স্কুলে আসো না কেনো?"
- "এমনিই স্যার। আসলে একটু অসুস্থ ছিলাম।"
- "অসুস্থ ছিলে? ও। আচ্ছা, নিপা কি তোমার সাথে কিছু করেছে?"
- "কই, না তো!"
- "আমি তো একটা ঘটনার কথা শুনলাম। তুমি কি সেইজন্যেই স্কুলে আসা ছেড়ে দিয়েছো?"
- "না না, তা হবে ক্যানো?"
- "স্কুলটা তো নিপা ম্যাডামের না! ও তো এই স্কুলের একটা কর্মচারী। ওর জন্য তুমি স্কুল ছেড়ে দেবে কেনো? তুমি স্কুলে আসো!"
- "না স্যার, নিপা ম্যাডামের জন্য তো আমি স্কুল ছাড়িনি।"
- "তাহলে কি জন্য ছেড়েছ?"
- "স্যার, আসলে আমার শরীরটা এত খারাপ থাকে..."
- "বেশ, এখন ঠিক আছো তো?"
- "হ্যাঁ, তা আছি।"
- "তাহলে পরশু থেকে স্কুলে এসো।"
- "বেশ, আসব।"
- "থ্যাঙ্ক ইয়ু সো মাচ।"
- "ইয়ু আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।....আচ্ছা স্যার, আমি কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?"
- "বলো!"
- "স্যার, আমার নাম্বারটা কি আপনাকে আব্বু দিয়েছে?"
- "না। তোমার নাম্বারটা তো আমার কাছে আগে থেকেই ছিলো।"
- "ও আচ্ছা। ঠিক আছে স্যার, তাহলে রাখছি আমি। ভালো থাকবেন আপনি।"
- "তুমিও ভালো থেকো।"
আমি জানি নাম্বারটা তাঁর কাছে আগে থেকেই ছিলো না। সিটিসেলটা নিয়েছি তখন মাসখানেক হলো, আর তিনি আমার সাথে কথা বলছেন দেড়মাস পরে। আগের নাম্বারটা ছিল ওয়ারিদের। সেটা আর তখন ইউজ করছি না আমি। তাঁর কাছে সেই নাম্বারটাই ছিলো। সিটিসেল নাম্বারটা থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
এটা তাঁকে আমার বাবাই দিয়েছে। তিনি মিথ্যে বললেন, আরো অনেক লুকোচুরি খেললেন, ভাব দেখালেন আমার "শরীর খারাপ ছিলো" তিনি বিশ্বাস করছেন- সবকিছুই আমাকে স্কুলে ফিরিয়ে নেয়ার স্বার্থে। হি হ্যাড টু কনভিন্স মি টু গো ব্যাক টু স্কুল, ইট ওয়াজ হিজ জব। অ্যান্ড হি হ্যাড টু কমপ্লিট দ্যা জব ফর মাস্ট, বিকজ মাই ফাদার টোল্ড হিম টু ডু সো। সেসব আমি ঠিকই বুঝেছি। তবুও ভদ্রলোকের অনুরোধেই আমি স্কুলে ফিরে গেলাম।
প্রত্যাবর্তনের প্রথম দিনেই নিপা ম্যাডাম আমাকে বললেন - "কাজী (আমার আগের নাম ছিলো কাজী আসিফ হাসান দীপ। এই নাম নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অনেক টিচারই আমায় জিজ্ঞেস করেছে "নিজেকে নাস্তিক বলছো, আবার নামের শুরুতে কাজী লাগাচ্ছ, মাঝখানে হাসানও দিচ্ছ, ব্যাপারটা কি?" নাইনে উঠে নাম বদলে তমসো দীপ রাখলাম। সে অবশ্য মুসলিম নাম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নয়। নামে কিছুই এসে যায় না, সব নাস্তিকই জানে। আমার এসএসসির রেজিস্ট্রেশন তমসো দীপ নামেই করা হোলো। নতুন পাসপোর্টও করিয়ে আনলাম তমসো দীপ নামে। তার পরও নিপা ম্যাডাম আমাকে কাজী নামেই ডাকতেন), আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন (আমাকে কখনো আপনি, কখনো তুমি করে বলতেন নিপা ম্যাডাম। ক্যানো, তা তিনিই ভালো জানেন)? মায়ের ওপর কি রাগ করতে হয়?"
আমি শুধু অস্ফুট কণ্ঠে বললাম, "না, আমি রাগ করিনি।"
তাঁর "মায়ের ওপর কি রাগ করতে হয়" শুনে আমার চিত্ত বিগলিত হয়ে যায়নি, কিন্তু কিছুটা ভালোই লেগেছিল।
ওনার মতো এমন একজন বোল্ড ওম্যান, লেখালেখি করলে (সেটা করার অবশ্য তাঁর কোনো কারণ নেই) তিনি নিশ্চিতই আরেকজন তসলিমা নাসরিন হয়ে উঠতেন, তাঁকে মা হিসেবে পেলে নেহাত মন্দ হত না। অ্যাট দ্যা এণ্ড অফ দ্যা ডে, নিপা ম্যাডামের প্রতি আমার ভালোলাগা রয়েই গিয়েছিল। এখনো আছে, যেমন আছে কণিকা ম্যাডামের জন্য। সেই কণিকা ম্যাডাম, যাঁর সাথে প্রথম পরিচয়ে তাঁকে ডেকেছিলাম কণিকা আপু বলে। ভাইবোনের মতো তাঁর সাথে মারামারিও করেছি, হাসিঠাট্টাও করেছি, রাত বারোটায় ফোন করে বিরক্তও করেছি।

একসময়ে আমাকে তিনি ভালোও বেসেছিলেন (অবশ্যই সেই ভালোবাসাটা প্ল্যাটোনিক)।
আমি যখন বলতাম, আচ্ছা কণিকা আপু, আমি কে? আমাকে নিয়ে আপনারা এত ভাবেন কেন?
- তুমি একটা ভালো ছেলে। খুব বেশি ভালো না, অন্যদের থেকে এ-ক-টু ভালো ছেলে। তাই তোমাকে নিয়ে ভাবি।
তাঁর অনুরোধেই আমার এই স্কুলে ভর্তি হওয়া, ভর্তি হয়ে দেখেছি আর দশটা স্কুলের তুলনায় এই স্কুলটার টিচাররা অনেক বেশি আধুনিক। অবশ্য ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার অনেক আগেই তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গ্যাছে। সেসব আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা, ২০০৬ সালের ঘটনা। ভর্তি পরীক্ষায় আমি অপ্রত্যাশিতভাবে দ্বিতীয় হলাম, তার কারণ- হাতেগোণা কিছু ছেলেমেয়ে সেবার পরীক্ষা দিয়েছে। ভর্তি হবার পর এই কণিকা আপুই হয়ে উঠলেন কণিকা ম্যাডাম, স্কুলে ঢুকে আমি অবশ্য নিজেই বলে দিয়েছিলাম "এখন থেকে আপনাকে কণিকা ম্যাডাম বলে ডাকব।" তারপরও কয়েকদিন ইচ্ছে করেই কণিকা আপু বলে ডেকেছিলাম বলে একদিন বলেছিলেন, "তুমি আমাকে আপু বলে ডাকো কেন? এসবে স্কুলের ছেলেমেয়েরা নানা কথা মনে করে, বোঝো না?"
কণিকা আপু ভীষণ শার্প ছিলেন, এখনো আছেন।
প্রথমদিকে স্কুলে আমার কথাবার্তা আমার তর্ক করা আমার বেয়াদবি সবই তিনি কিছুটা পছন্দই করতেন, অবশ্য সতর্কও করে দিয়েছিলেন একবার- "এরকম করলে তো তোমাকে স্কুলে রাখবে না।"
- "রাখবে না মানে?"
- "তোমাকে বের করে দেবে।"
২০০৭ এ যখন প্রথম ভর্তি হলাম, আমাকে দেয়া হয়েছিলো হোয়াইট সেক্সানে। হোয়াইট সেক্সানটা এ গ্রেডের ছাত্রদের, গ্রীন বি দের, আর ব্লু সি দের। আমাকে প্রথমেই হোয়াইট সেক্সানে দেয়া হয়েছিল ভুল করে। তখন হোয়াইটের ক্লাস টিচার ছিলেন মামুন স্যার। প্রথম দিনেই ক্যাপ্টেন নির্বাচন করা হোলো।
ক্যাপ্টেনেরা ছেলেমেয়েরা ক্লাস ছেড়ে বাইরে গেলেই নাম লিখত, এবং মামুন স্যার তাদের ধরে ধরে মারতেন। আমার স্বভাবতই এইটা পছন্দ হয় নাই। আমি একদিন বললাম, বাংলাদেশে শিশুদের গায়ে হাত তোলার বিরুদ্ধে আইন আছে। আপনি এরকম করতে পারেন না।
- হোয়াট?
- স্যার, আমি জানি না আপনি "আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী" বইটা পড়েছেন কি না। বইটা পড়ে আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আনা লিখেছে, সেই হিটলারের আমলে অব্দি ইহুদীদের জন্য বরাদ্দ আলাদা স্কুলেও ক্লাসে তারা দিব্যি কথা বলত, এবং এজন্য তাদের কেউ কোনো রকম শাস্তি দিত না। উলটো আনার অতিরিক্ত কথা বলায়
এক শিক্ষক বিরক্ত হয়ে তাকে একটা কবিতা লিখে আনতে বললে সে ব্যঙ্গ করে লিখেছিল - বকবকচঞ্চুর গিন্নি বলল প্যাক প্যাক প্যাক!
সেখানে আমরা আজ ২০০৭ সালে বাংলাদেশে বসে আছি, আর আপনি স্রেফ দুই ক্লাসের ফাঁকে অফটাইমে ছাত্রছাত্রীরা বাইরে যাচ্ছে বলে তাদের শাস্তি দিচ্ছেন, এটা ঠিক নয়।
স্যার জানি না কেনো একটু নরম হলেন। বললেন- বইটা আমি পড়েছি। মারা ছাড়া কি করে এই বাচ্চাদের সামলানো যায়, সেটা আমায় বলতে পারবে তুমি? এতই যদি বোঝো, বেশ, তোমাকে এখন থেকে ক্লাসের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেয়া হলো।
আমি বললাম- বেশ।
পরদিন আমি সাথে করে হুমায়ুন আজাদের কিশোর সমগ্রটা নিয়ে এলাম, তখনও আমি হুমায়ুন আজাদের ভক্ত।
প্রথম ক্লাস শেষ হলো। পরের ক্লাস শুরু হতে কিছু সময় বাকি। এই সময়টা ছেলেমেয়েদের হইহল্লা করার। আমি এই হইহল্লার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এই হইহল্লা বন্ধ করার। এবং আমাকে সেটা করে দেখাতে হবে। নইলে ব্যাক টু ওল্ড চাল ডাল, অর্থাৎ আবার ক্যাপ্টেনের নাম লেখা আর সেই নামের তালিকাভুক্তদের মারধোর।
আমি টেবিলের সামনে গিয়ে কিশোর সমগ্রটা খুলে জোরে জোরে "আমাদের শহরে একদল দেবদূত" পড়তে শুরু করলাম।
প্রথম কয়েক মিনিট কেউ ফিরে তাকায়নি, আস্তে আস্তে সবাই আমার কণ্ঠে কান পাতল। এমন বাক্য তারা কখনও শোনেনি, বাক্য এমন সুন্দর হতে পারে তাদের জানা ছিল না, বাক্য এত ধারালো হতে পারে তারা কল্পনা করতে পারে না (এসবে আমিও তখন মুগ্ধ হতাম, হুমায়ুন আজাদের সব বইতেই হতাম। এখন আর হই না)।
দু'মিনিটেই সবাই চুপ করে গেলো। আমি আবৃত্তি করে যেতে লাগলাম, তারা চুপ করে শুনতে লাগল। যেন আমি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছি। সবাই হিপনোটাইজড।
মিনিট পাঁচেক পর মামুন স্যার এলেন।
আমি নিজের জায়গায় গিয়ে বসলাম।
তিনি যথেষ্ট অবাক। আশেপাশের ক্লাসের টিচাররাও আমার পড়া শুনেছে, তারাও যথেষ্ট অবাক। কারণ, ছেলেমেয়েগুলোকে সত্যিই আমি সম্মোহিত করতে পেরেছি।
মামুন স্যার বললেন- কি পড়ছিলে পড়ো।
আদেশ পেয়ে আমি আবার গিয়ে পড়তে শুরু করলাম...
"তারা বলে, 'বৃষ্টির কথা তো কেউ আমাদের কখনো বলেনি।'
আমি বলি, 'বৃষ্টির কথা এ-শহরে সবাই ভুলে গেছে।'
তারা জানতে চায়, 'বৃষ্টি কাকে বলে?'
ওদের কথায় আমি..........."
মামুন স্যার বলে উঠলেন- ঠিক আছে কেউ ছাতা আনেনি। সবাই ভিজে যাচ্ছে। তুমি তোমার জায়গায় গিয়ে বোসো।
আমি আমার জায়গায় গিয়ে বসলাম।
মামুন স্যার হোমওয়ার্ক চেক করলেন সবার, একে একে। তারপর বললেন, যতদিন দীপ হোয়াইটে আছে, ও-ই ক্যাপ্টেন থাকবে।
সেদিন ডায়েরী সাইনের সময় মামুন স্যার আমাকে গান গাইতে আদেশ করলেন। আমি তো গান গাইতে জানি না, গানের গলা আমার নেই। কিন্তু তাঁর আদেশ, আমাকে গাইতেই হবে।
গাইতেই যখন হবে, তখন বাধ্য হয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা দুলিয়ে গেয়ে উঠলাম-
"Jimmy please say you wait for me,
I will grow up some day you see..."
তিনি বললেন, না, ইংরেজী নয়। বাংলা কিছু গাও।
- বেশ।
'ভাবছো তুমি সুতোর টানে নাচবে সবাই,
ভাবছো লোকে দিচ্ছে তোমায় হাততালি তাই...'
যতদূর মনে ছিল, গেয়ে দিলাম। গাওয়া শেষ করার সাথে সাথে ক্লাসের সবক'টা ছেলেমেয়ে মিলে হাততালি- গান যে এত সুন্দর হয়, সে কথাও তারা জানত না। "ধুম মাচালে
ধুমে"র চেয়ে উৎকৃষ্ট গান তারা কখনো শোনেনি।
মামুন স্যার বললেন, তোমার গলা হয়তো ভালো নয়, কিন্তু গানের চয়েস তো চমৎকার! বাড়িতে কে কে আছে?
আমি বললাম, মা, বাবা, ছোট ভাই।
- সম্পর্ক কেমন তাদের সাথে?
বুঝলাম, আমার বাবা স্কুলের টিচারদের জানিয়েছে বাসায় আমি কারো কথা শুনি না। অতএব আমার চরিত্র সংশোধন করার ভার এরা সানন্দে কাঁধে তুলে নিয়েছে। "সম্পর্ক ভালো" বলে সেদিনের মতো এড়িয়ে গেলাম।
কিছুদিন পর, যেহেতু আমি নতুন ছাত্র, যেহেতু হোয়াইটে পড়তে হলে একটা ভালো রেজাল্ট থাকতে হয়; সেহেতু আমাকে গ্রীনে পাঠানো হলো। কণিকা আপু বাংলা দ্বিতীয় পত্র নিতেন।
একদিন তিনি ক্লাসে এলেন। বললেন, তোমাদের আগের ক্লাস কি ছিল?
- বিতর্কের ক্লাস।
- কি বিতর্ক শেখালো তোমাদের?
আমি বললাম, "বারোয়ারী বিতর্ক।"
- সেটা আবার কি?
বললাম, "একটা টপিক দেয়া হবে, সে নিয়ে সবাইকেই নিজের মতো করে পক্ষে বলতে হবে। বিপক্ষ নেই।"
- এটা আবার কি ধরনের বিতর্ক?
একই কথা আমিও আগের ক্লাসে বলেছি। আমার মুখ থেকে "এটা আবার কি ধরনের বিতর্ক, বিপক্ষই নাই" শুনে ছেলেরা আমাকে ধমকে দিয়েছিল, আমাদের বিতর্কের শিক্ষক এই বিতর্ক আবিষ্কার করেছেন বলে। কণিকা আপুর মুখ থেকে একই কথা শুনে ছেলেরা এবার আর কিছু বলল না। কণিকা আপু বললেন- তোমাদের আমি এখন একটা বিষয় দিচ্ছি। এটা নিয়ে তোমরা সংক্ষেপে পক্ষে বিপক্ষে বলবা।
ছয়জন ছাত্রছাত্রী সিলেক্ট করলেন তিনি। আমি পড়লাম বিপক্ষে, বিষয় - "দেয়ালিকাই বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মেধা বিকাশের একমাত্র মাধ্যম।"
বাকি সবাই আমতা আমতা করে গঁৎবাঁধা কিছু কথা বলে গ্যালো। দু'একজন বলতেই পারল না।
অবশেষে আমার পালা এলো। আমাকে অনেকক্ষণ ধরেই আমার দলের বাকি দু'জন বলছে "তুমি এমন করে বলবা, যাতে সবাই মুগ্ধ হয়া যায়।"
আমিও "বেশ, বলব" বলে যাচ্ছি।
কণিকা আপু বললেন- এবার কাজী আসিফ হাসান দীপ, তুমি বলবে।
আমি বললাম। এতদিন পরে কি বলেছিলাম তা পুরোপুরি মনে নেই, আবছা আবছা যেটুকু মনে আছে সেটুকুর সাথে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা এখন মিলিয়ে মিশিয়ে তুলে দিচ্ছি, এর কাছাকাছিই বলেছিলাম, যা বলেছিলাম-
"আমরা আসলে এখনও অনেক ছোট আছি। আমরা নিজেও জানি না আমরা কতটা ছোট। আমাদের জন্য দেয়ালিকা ছাড়া লেখালেখি করার জন্য আর কিছু বরাদ্দ রাখা হয়নি। পড়ার জন্য হুমায়ুন আহমেদ ছাড়া আর কোনো লেখক রাখা হয়নি। দেখার জন্য টাইটানিক ছাড়া আর কোনো ছবির কথা মাথায় ঢোকার সুযোগ দেয়া হয়নি। এজন্য আমরা যখন হুমায়ুন আহমেদ পড়ি, তখন আমাদের লিখতে ইচ্ছে হয় "ইস্কুল বড়ই মজার স্কুল" ধরনের বাক্য (এটা আসলে আমারই একটা গল্পের লাইন। গল্পটা একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, শ্রেষ্ঠ গল্পও হয়েছিল। আর সেই পত্রিকাটা চালাতো যে সংগঠন, কণিকা আপু ছিলেন তার সভাপতি। সে আরো আগের কথা। দু' হাজার চার সালের। তখন আমি মাত্র এগারো।), টাইটানিক দেখলে ইচ্ছে করে কেট উইন্সলেট-লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও'র মতো বিলিতি অঙ্গভঙ্গি করতে, আর দেয়ালিকায় লিখতে বলা হলে লিখতে ইচ্ছে করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের মতো কিছু গঁৎবাঁধা বিষয়ে, অথবা বড়জোর 'এই আমাদের সুন্দর গ্রাম, গাছে গাছে ফলে শত শত আম" ধরনের ছড়া। এভাবে কোনোদিনও মানসিক বিকাশ হয় না। এসব নিয়েই পড়ে থাকলে আমরা যে আঁধারে আছি সেই আঁধারেই রয়ে যাবো। আমাদের চিন্তাভাবনায় কোনো পরিবর্তনই আসবে না। আমার মতে, সত্যিকারের মানসিক বিকাশের জন্য আমাদের দরকার বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র দেখা, বই পড়া এবং বিতর্ক করা...."
কণিকা আপু বলে উঠলেন- ঠিক আছে, তোমার মূল্যবান বক্তব্যের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি তোমার নিজের জায়গায় ফিরে যাও।
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সবাই একসাথে হাততালি দিয়ে উঠল, দু'একজন বাদে। এই দু'একজন আমার কথা শুনে এতক্ষণ "হা হা হা হা হো হো হো" করে হেসেছে।
কণিকা আপু তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - কি ব্যাপার, হাসছো কেনো? হাসার কি হয়েছে?
সজল নামের একটা ছেলে বলল - ওর বক্তব্যটা আমার কাছে খুব আজব লেগেছে ম্যাডাম। ও দেয়ালিকার কথা বলতে গিয়ে টাইটানিক, বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল ইত্যাদিতে ঢুকে গ্যাছে। খুব ইন্টারেস্টিং। হা হা হা হা হা"
কণিকা আপু বললেন- ইন্টারেস্টিং বানানটা যেনো কি?
এবার ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সমস্বরে হেসে উঠল, শুধু সজল আর সেই দু'একজন বাদে।
এই কণিকা আপুই আমাকে একসময় অপমান করা শুরু করলেন। প্রত্যেকটা ক্লাসে আমাকে অপদস্থ করতেন।
তাতে আমি খুব বেশি মনঃক্ষুণ্ণ হইনি। ওনার সাহস, ওনার আধুনিকতা, ওনার বোল্ডনেস; যার জন্য ক্লাসের অনেক ছেলেই "কণিকাটা বেশি বোঝে। পুরুষ পুরুষ ভাব" বলে আড়ালে গালমন্দ করত, তার জন্য আমার সবসময়ই ওনার প্রতি ভালোলাগা ছিল, আজও আছে।
কিছুদিন আগে সবাই যখন রঞ্জনদা আর আরেফাদির বিয়ে সেলিব্রেট করছেন, ঠিক সেই সময়টাতেই কণিকা আপু একটা কাণ্ড করেছেন। অনেকগুলো বছর প্রেম করার পর বিয়ে করেছেন সাজু ভাইয়াকে। সাজু ভাইয়া মুসলমান ঘরের ছেলে, কণিকা আপু হিন্দু ঘরের। দু'জনেই নাস্তিক। সাজু ভাইয়াকে আমি পাঁচ বছর আগে থেকেই চিনি। তিনিও কয়েকদিন আমাদের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে রাত দিন খাটায় বলে ছেড়ে দিয়েছেন। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন, তা নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই। আমি যখন ওদের দলে ছিলাম, আমাদের কারোরই ছিল না। কারণ, আমরা সবাই জানতাম সাজু ভাইয়ার আসল পরিচয় তিনি কবি। অনেক আগে একটা বইও বার করেছিলেন, বেশ ভালোই ছিল বইটা। বইটার একটা কবিতারও কোনো নাম দ্যাননি, কারণ, ওনার মতে, "মানুষ সারাজীবনে একটাই কবিতা লেখে, সেটার নামের দরকার হয় না।" আমরা সবাই জানতাম তিনি কণিকা আপুর প্রেমিক।
কণিকা আপুর পরিবার বিয়েটা মেনে নেয়নি। এ নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন কণিকা আপু। স্কুলের সবাইকে বিয়ের মিষ্টি খাইয়েছেন কিছুদিন আগে, মিষ্টি খাওয়ানোর পর এখনও এক সপ্তাহ কাটেনি।
আমি সবই দূর থেকে শুনেছি। দূর থেকে শুভকামনা জানিয়েছি মনে মনে। দূর থেকে বলেছি "স্যালুট কণিকা আপু"।
যে বন্ধুটা আমাকে বিয়ের খবরটা জানিয়েছে, সে একদিন আমাকে কণিকা আপুর বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আমি যাইনি। যাওয়ার উপায় নেই। অনেকদিন ধরেই কণিকা আপুর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। সবার সাথেই যেমন হয়, কণিকা আপুর সাথেও একের পর এক ব্যক্তিগত দ্বন্দে জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। একটা পর্যায়ে আপনা থেকেই বন্ধুত্বটা চুকে গ্যালো। পরীক্ষার সময় ছাড়া স্কুলে যাওয়াও তেমন হয়ে ওঠেনি গতবছর। স্কুলেও দেখা হয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়েছিলাম, তখন রাস্তায় এক ঝলক দেখেছি- রিকশা নিচ্ছেন তিনি। আর একদিন আমি রিকশায় করে বাসায় ফিরছি, দেখি ফোনে কথা বলতে বলতে আমাদের গলি দিয়েই যাচ্ছেন। আর হয়তো কখনোই কথা হবে না কণিকা আপুর সাথে। কিন্তু ভালোলাগাটা সবসময়ই থাকবে।
কণিকা আপুর কথা এল নিপা ম্যাডামের কথা বলতে বলতে। আমার সেই প্রগতিশীল নিপা ম্যাডামও টেস্ট পরীক্ষার সময় যেদিন ধর্মের পালা এলো, ক্লাসে এসে আমাকে বাদে সবাইকে প্রশ্ন দিলেন। আমি যখন বললাম "ম্যাডাম, আমি প্রশ্ন পাইনি", তিনি বললেন- "সে কি?"
ক্লাস টিচারের কাছে ম্যাডাম একটা হিন্দু ধর্মের প্রশ্ন চাইলেন, "এই রেজা, একটা হিন্দু ধর্মের প্রশ্ন দিন তো!"
- "ম্যাডাম, আমি তো ইসলাম ধর্মে পরীক্ষা দিচ্ছি।"
- "ওহ, তাই নাকি? আমি তো আপনাকে হিন্দু ভেবে হিন্দু ধর্মের প্রশ্ন নিয়ে এসছি!"
ক্লাসের সবাই হা হা, হে হে, হো হো, হি হি।
আমি বললাম, "ম্যাডাম, এই ক্লাস টেনের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যা করছে করুক, যা বলছে বলুক।
কিন্তু আপনি আমাকে এটা নিয়ে মক করতে পারেন না। আপনার তো বোঝার ক্ষমতা আছে যে আমার কিছুই করার নেই! উপায় থাকলে আমি কি ইসলাম ধর্ম নিতাম? যদি বাংলাদেশে নাস্তিকতা পড়ানোর সিস্টেম থাকত, আমি নাস্তিকতা নিয়েই পড়তাম। নেই বলেই বাধ্য হয়ে আমাকে ইসলাম ধর্ম পড়তে হয়। এটা নিয়ে ক্লাস টেনের ছাত্ররা আমাকে ক্ষেপানোর বৃথা চেষ্টা করতে পারে, তাই বলে আপনি?"
ম্যাডাম এগিয়ে এলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- "স্যরি কাজী। আমি আপনাকে মক করতে চাইনি।"
এ তো গ্যালো শুধু পরীক্ষা আর ক্লাস। যখন রমজান আসত, আমি নাস্তিক জেনেও ক্লাসের সবাই জিজ্ঞেস করত - তমসো, আজকে রোজা রাখছ?
আমি বলতাম, তোমরা জানো না আমি নাস্তিক? আমি রোজা রাখতে যাবো ক্যানো?
ওরা বলত, হিন্দুরাও তো উপবাস করে। উপবাস তো আসলে রোজাই। রাখতে ক্ষতি কি?
আমি বলতাম, আমি হিন্দু নই। মুসলমানও নই।
ওরা বলত, তাহলে তুমি কি? কিছু তো একটা হতে হবে।
আমি বলতাম, কেন হতে হবে?
ওরা বলত, সবাই তো হয়। একটা না একটা ধর্ম তো সবাই মানে।
আমি বলতাম, সবাই মানে বলেই মানতে হবে?
ওরা বলত, এত লোকে মানে, সবাই কি ভুল মানে? সবাই কি ভুল বলে?
আমি বলতাম, সবাই মিলে একটা কথা বললেই সেটা ঠিক হয়ে যায় না। আমি এসবে বিশ্বাস করি না। কোনো ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ করে না খেয়ে থাকার আদিখ্যেতা দেখানোর কোনো আগ্রহ আমার নেই। আমি নাস্তিক। ব্যাস।
স্বাভাবিকভাবেই ওরা চুপ করে যেতো, সম্ভবত নাস্তিকের প্রতি ঘেন্নায়। কখনো কখনো বলতো- মরলে পরে বুঝবা আল্লাহ আছে কি নাই।
আমি বলতাম, ঠিক আছে। সেটা আমি মরার পরে দেখব।
ওরা বলত- তখন তো আর দেখার সময় পাইবা না। তখন আফসোস করবা। আফসোস কইরাও ত্যখন কোনো লাভ হইব না।
আমি বলতাম, বেশ। সে আমি দেখব' খন। সেটা আমার চিন্তা। তোমরা তোমাদের নিজেদের চরকায় তেল দাও।
সে কথা বেশিক্ষণ মাথায় থাকত না কারো। পরের পিরিয়ডেই আবার কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করে বসত, কি দীপ, এবার কয়টা রোজা রাখবা?
আমি ভেতরে ভেতরে জ্বলতাম। ইচ্ছে হতো ধরে ধরে থাপড়াই একেকটাকে। মুখে সেই রাগটা প্রকাশ করতাম না। ওরা আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি চালিয়ে যেতো।
এরকম আরো অনেক ইয়ার্কির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমায়, আমার নাস্তিকতা নিয়ে। সর্বশেষ ইয়ার্কিটা করলেন ব্রাত্যদা, সেই ইয়ার্কিটা ওই ক্লাস টেনের ছানাপোনাদের ইয়ার্কির থেকে খুব একটা বেশি পরিপক্ক ছিল না। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে চেয়েছেন, করেছেন। আমার ওপর ক্ষেপে ছিলেন, তার ঝাল ঝেড়েছেন। বেশ করেছেন,
ঝাড়তেই পারেন তিনি। ঝাড়ার অধিকার তাঁর আছে। শুধু বাস্তবতাটা পুরোপুরি জানা নেই।
যেসব ঘটনার কথা বললাম, এগুলোই একমাত্র ঘটনা নয়, এরকম আরো আছে। এখন সেগুলোর সব ভালো করে মনেও করতে পারি না। বেশিরভাগই আবছা আবছা মনে পড়ে, আবছা আবছা শুনতে পাই দু'একটা সংলাপ। মোটামুটি সবই চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে আমার জীবনে অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গিয়েছে, এই সমাজে
বসে সত্যিকারের প্রগতিশীল হতে গেলে যেসব ঘটে থাকে। সেসবের তুলনায় এসব ছোটখাট ব্যাপার খুবই তুচ্ছ। আর তাছাড়া এই ঘটনাগুলো সবই স্কুলকেন্দ্রিক। আমার জীবন কখনোই স্কুলকেন্দ্রিক ছিল না। স্কুলের বাইরে আমার একটা ব্যক্তিগত জীবন ছিলো, এখনও আছে। সেই জীবনে অনেক বড় বড় সুখ ছিল, অবধারিতভাবে সুখের পালা শেষে দুঃখও ছিল। সেসবের তুলনায় এসব খুব তুচ্ছ। তারপরও ধান ভানতে অনেক শীবের গীত গাইলাম। কারণ, লিখতে বসে হঠাৎ করেই অনেকগুলো কথা একসাথে মনে পড়ল। যতই তুচ্ছ হোক, এগুলোও আমার অতীত। স্কুলের মতো একটা জায়গায় বসে আমি যে-সব কাণ্ড করেছি, বাংলাদেশের আর কোনো স্কুলবয় সেসব করতে পারে কি না
আমার জানা নেই। অহংকার করে বলছি না, সত্যিটাই বলছি। স্কুলের বাইরেও অনেক কিছু করেছি। তেরো বছর বয়সেই প্রেমে পড়েছি, সে অবশ্য আজকাল অনেক তেরো বছরই পড়ে। কিন্তু তাদের প্রেম হলো সারারাত ফোনে কথা বলা, ইয়ার্কি মারা, মোবাইল সেক্স করা। আমার প্রেম সেরকম ছিল না। আমি প্রেমে পড়ে শুধু অপেখা করেছি, অপেক্ষা শেষ হয়েছে যখন বুঝেছি যার প্রেমে আমি পড়েছি সে আসলে আমার প্রেমে পড়েনি। নইলে দিন শুধু কেটে যায়, সে আমার সাথে দেখাও করে না ক্যানো? আসলে সে আমাকে সামাজিক করতে চেয়েছিল। আর দশটা ছেলের মতো করতে চেয়েছিল। সেজন্য তাকে আমার কাছাকাছি আসতে হতো, সেজন্যই মিথ্যেটা বলেছে। যেদিন কথাটা বুঝতে পারলাম, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গ্যাছি। রাত তিনটায় উঠে দেখেছি কম্পিউটার অন, রবীন্দ্রসংগীত তখনও হাইভল্যুমে বেজে চলেছে রবীন্দ্রসংগীতের মতো, অথচ আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমি শুধু শুনছি একটা পাহাড় ধ্বসে পড়ার শব্দ। আমার শুধু মনে হচ্ছে "ও তো আমার কাছে কখনোই আসবে না", আর আমি কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে মনে হচ্ছে "আমি এখন কি করে বাঁচব? আমায় তো আত্মহত্যা করতে হবে, মনে হচ্ছে আর আমি কাঁদছি। কাঁদছি আর দেখছি যে ছিল আমার ঈশ্বর, যাকে নিয়ে আমি কল্পনার একটা জগত গড়ে তুলেছিলাম, সেই জগতটা আমার চোখের সামনে প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে স্বপ্নের টুইন টাওয়ার। ওপরে তাকিয়ে দেখছি ঘরের সিলিংটা আমার ওপর তিনকোণা হয়ে নেমে আসছে।
সেদিনই বুঝেছি সে আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। তবু আমি তাকে বোকার মতো ভালোবেসে গ্যাছি। এরও তিন তিনটা বছর পর তার জন্য আত্মহত্যাও করতে গ্যাছি।
এ তো শুধুই প্রেম। এটাই আমার একমাত্র কষ্ট ছিল না। একমাত্র এক্সপেরিয়েন্স ছিল না।
অসামাজিক ছিলাম বলে পরপর দু'দুটো বাসা থেকে আমাকে সপরিবারে বের করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটা ছিলো সরকারি কলোনি। আমি কোনো অপমান বোধ করিনি। আমার বরং হাসিই পেয়েছিল। কারণ, আমি জানতাম যে আমি যেরকম ছেলে, তাতে এরকমই এই সমাজে হওয়ার কথা। কিন্তু আমার বাবা কলোনি থেকে বিতাড়িত হওয়াকে তার সামাজিক সম্মান তার ছেলে ধুলোয় লুটিয়ে দিলো হিসেবে নিয়েছিলো। এ নিয়ে তো বটেই, এ ছাড়াও আরও অনেক কারণে আমাকে যদিও ভয় পেতো, তবু আমার ওপর মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে আমাকে বাগে আনতে, শেষ পর্যন্ত পারেনি। একসময় মেনে নিয়েছে আমার নাস্তিকতা, আমার তসলিমা-ভক্তি, আমার সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়া, আমার একা একা চট্রগাম-সিলেট তো বটেই, ভারতও অব্দি ঘুরে আসা, আমার ইণ্ডিভিজ্যুয়ালিটি, আমার এই বয়সেই ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে যাওয়া, আমার আরো অনেক কিছু।
যে সংগঠনটায় জড়িয়েছিলাম, ভেবেছিলাম যাদের নিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবো, সেই তারা আমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে তাদের সাথে মতে মেলেনি বলে, আমার মত অসামাজিকের উপস্থিতি তাদের বিব্রত করেছে বলে। আমার আত্মসম্মানবোধ বেশি ছিল বলে ফিরে যাইনি। কিন্তু আত্মসম্মানবোধ কষ্ট পাওয়া আটকাতে পারেনি। তাতে অবশ্য কারো কিছু এসে যায়নি। আমার কষ্ট আমি পেয়েছি, আমার হতাশায় আমি ভুগেছি, আমার ভ্রান্তিতে আমি দিক হারিয়েছি, আমার অন্ধকারে আমি ডুবে গেছি। ওদিকে সবার জীবন যেমন ছিল তেমনই চলেছে।
আরও অনেক কিছু ঘটে গ্যাছে আমার জীবনে, তার সবকিছু বলার সাহস আমার নেই। শুধু এটুকুই বলতে পারি, এই সমাজে বসে তেরো বছর বয়সে প্রগতিশীল হতে গেলে যে কি পরিমাণ নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেটা ব্রাত্যদারা কল্পনাও করতে পারবে না। ব্রাত্যদা ইউনিভার্সিটির ছাত্র, তাঁর চিন্তাভাবনা কথাবার্তার একটা সামান্য হলেও
সামাজিক স্বীকৃতি আছে। সমাজ সামান্য হলেও স্বীকার করে একজন বাইশ বছরের যুবক এই যুগে এসে একটু ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু সেই জায়গায় সমাজ তেরো বছরের একটা ছেলেকে কল্পনাও করতে পারে না। বাইশ বছরের ব্রাত্যদের যত কিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তার থেকে অনেক বেশি কিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হয় তমসোদের। অবশ্য তমসোরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। স্টিল দে ডু এক্সিস্ট, ইভেন ইন আ কান্ট্রি লাইক বাংলাদেশ। ব্রাত্যরা তাও তাদের এক্সপেরিয়েন্সের কথা বীরত্বগাঁথার মতো করে বর্ণনা করতে পারে, তমসোরা তাও পারে না। কারণ তাদের এক্সপেরিয়েন্সগুলো আরো অনেক বেশি অন্ধকার, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। সেসব নিয়ে বীরত্বগাঁথা রচনা করা যায় না। সেসব বলা তো দূরে থাক, তমসো "আমার বয়স আঠেরো" বললেই সেখানেই কিচ্ছা খতম। সেখানেই "তুমি তো একটা বাচ্চা! তুমি এসব নাস্তিকতা নারীবাদের হুমায়ুন আজাদের কি বুঝবে অথবা তুমি আল্লাখোদার কি বুঝবে" বলে সবাই হেসে এড়িয়ে যায় তাকে। তার কথার আর কোনো গুরুত্ব থাকে না।
আজ আমার এই লেখাটা পড়ার পরও অনেকের কাছেই আমার আর কোনো গুরুত্ব থাকবে না। না থাকুক। অনেকেই আমার ওপর আস্থা হারাবে। হারাক। অনেকেই আমাকে
নিয়ে হাসাহাসি করবে। করুক। অনেকেই আমাকে মিথ্যুক বলবে। বলুক। অনেকেই আমার সাথে আর কোনো সিরিয়াস আলোচনায় যাবে না। না যাক। অনেকেই আদিখ্যেতা দেখিয়ে অকারণে সিরিয়াস আলোচনা করতে এগিয়ে আসবে 'তুমি একা নও, আমরা তো আছি' ধরনের অবজ্ঞা মেশানো ভাব দেখাতে। দেখাক।
যেহেতু ব্যাপারটা এক্সপোজ হয়েই গেছে, এ নিয়ে আর লুকোছাপা করার কোনো দরকার নেই। ব্রাত্যদা হয়তো খুব একচোট হেসেছেন "তমসোর মুখোশ খুলে দিয়েছি" মনে করে। নিজে একবারও ভেবে দেখেননি আমার জায়গায় থাকলে তিনি কি করতেন। না দেখুন। অবশ্য ব্রাত্যদাই প্রথম বলেনি আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রথম বলেছিলেন
তসলিমা নাসরিন। মেইলে আমার সম্পর্কে সবই তাঁকে জানাই, কালেভদ্রে তাঁর কাছ থেকেও দু'একটা মেইল আসে। সেভাবেই জানতেন আমার সামনে পরীক্ষা। বছরের গোড়ায় একটা গ্রুপ খুলেছিলেন তিনি। সে গ্রুপেই যখন আমি বললাম আমি চলে যাচ্ছি পাঁচ মাসের জন্য, তিনি বলেছিলেন "পাঁচ মাস কি করবে? তোমার না সামনে পরীক্ষা?
সে তো জানুয়ারিতে, তাই না?" উনি পরিস্কার করে বলেননি কি পরীক্ষা। তবে অনেকেই বুঝে নিয়েছিলো, যখন মুনদি আমার কথাতেই বললেন "তমো'র পরীক্ষা ফেব্রুয়ারিতে।" এ বছর ফেব্রুয়ারিতে কী পরীক্ষা, সবাই জানত। ব্রাত্যদাও হয়তো তাঁরই কোনো ছাত্রের কাছ থেকে ধর্ম পরীক্ষার তারিখটা জেনেছেন। প্রথম পরিস্কার
করে বলেছিলেন দিবাকরদা। তখন আমার ইন্টারনেট অফ, কিন্তু সাইবার ক্যাফে থেকে দেখেছি। এরপর সালমাদিও আমাকে এসএসসি পরীক্ষার জন্য শুভকামনা জানিয়েছিলেন। এরপর তো আর কারো জানতে বাকি থাকার কথা নয়, এতদিন যে ছেলে এত তিরিংবিরিং করেছে- সে আসলে ক্লাস টেনের ছাত্র! অনেকেই হয়তো চোখ কপালে তুলেছে, আবার অনেকেই হয়তো মনে মনে দাঁতালো হাসি হেসে বলেছে "হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন, তসলিমার কলাম নাইন টেনের ছাত্রছাত্রীরা পড়তে পারে, ও কলাম তাঁর জন্য নয়।" এসবে আমার কিছুই যায় আসে না। কে কার কি পড়তে পারে সে কথা আমি ভালো করেই জানি। আমার হতাশা আমার সুখ আমার দুঃখ আমার বোধ আমার বোকামি - এসবের খবরও আমার চেয়ে ভালো করে আর কেউ জানে না। আজ এই লেখাটা লিখবার পর নাগুর লেনিন হায়দারেরা আমাকে নিয়ে হয়তো আরেক চোট মশকরা করার বিরাট সুযোগ পেয়ে যাবে। পেয়ে যাক। হয়তো অনেক আজেবাজে কথা বলবে। বলুক। আমি এসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাবতে রাজি নই। কারণ, আমি কি আমি কেব আমি কি করে - তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমারটুকু আমি জানলেই চলবে। আর কারো জানতে হবে না।
কেউ কেউ অবশ্য আগে থেকেই জানত। জানি না কিভাবে। ব্রাত্যদা জানতেন, ব্রাত্যদার বন্ধু মাইকেল দীপ জানতেন, আরও কেউ কেউ জানতেন। সেই আরও কেউ কেউদের
নাম আমার জানা নেই। ব্রাত্যদা'র সাথে আমার দু'বার মাত্র দেখা হয়েছিল। দ্বিতীয়বারে তিনি জানিয়েছেন আমার ঠিকুজি কুলুজির খবর তাঁর কাছে অনেক আগে থেকেই ছিল।
কি করে ছিল, তা অবশ্য জানাননি। জানিয়েছেন, আমাকে নিয়ে নাকি তাঁর ইনবক্সে গ্রুপ মেসেজে আলোচনা হয়েছে, অনেকেই নাকি অভিযোগ করেছেন "ও ও-ই তসলিমা
নাসরিন নিয়েই পড়ে থাকবে।" ব্রাত্যদাই নাকি তাদের বুঝিয়েছেন "একেকজনের পছন্দ একেকরকম।" কেন আমার হয়ে গায়ে পড়ে দুনিয়ার লোককে তমসো'র চয়েজ আলাদা হতেই পারে বোঝাতে গিয়েছেন, তা আমাকে ব্রাত্যদা বলেননি। আমাকে নিয়ে এদের চিন্তা করার কারণ কি, তাও জানাননি। তাদের কাছে হয়তো আমার আজকের এই লেখাটা কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে না। না করুক।
মাঝে মাঝে চিৎকার করে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে, "প্লিজ, লেট মি ডাই ইন পিস। লিভ মি অ্যালোন।" বলিনা, কারণ- সেকথাও কেউ বুঝবে না। যতই নাস্তিক হোক,
আর যতই প্রগতিশীল হোক, এরাও তো এই সমাজেরই সদস্য। পরচর্চা এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তার থেকে এরাও আলাদা হতে পারেনি।
ব্রাত্যদাও না।
আলাদা হতে না পারুন, পেছন থেকে ছুরিটা না মারলেও পারতেন। ছুরি মারাতে আমার আপত্তি নেই আগেই বলেছি, কিন্তু ছুরিটা সামনাসামনি মারা উচিত ছিল। সামনাসামনি বলতে আমাকে অ্যাড করে আমার প্রোফাইলেই তাঁর জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল নাস্তিক হয়ে আমি কি করে ধর্ম পরীক্ষা দিই, তা বলছি না। একটা গ্রুপেও বলতে
পারতেন তিনি। তাহলে ফিরে এসে আমার সেখানে উত্তর দেয়ার সুযোগ থাকত। বললেন নিজের প্রোফাইলে, যেটা আর সবাই দেখলেও আমি দেখতে পাবব না।
যা হোক। আরও অনেক বাজে তর্কের অবতারণা করতে পারতাম আমি। করলাম না। দরকার নেই তার। অ্যাট দ্য এণ্ড অফ দ্য ডে, ব্রাত্যদাকে ধন্যবাদ। কারণ, উনি ওই স্ট্যাটাসটা না লিখলে হয়ত আমি আজকে এই লেখাটা লিখতাম না। যেসব কথা আদ্যোপান্ত ভুলে বসে ছিলাম, সেসব মনে পড়ত না। আর যদি মনে না পড়ত, এই যে ছ'
ঘন্টা ধরে লেখাটা লিখলাম, এই ছ'টা ঘন্টা আমার মন ভালোলাগায় ভরে ছিল, অনেকদিন পর অতীতের সুবাস পাচ্ছিলাম - সেটাও পেতাম না। অনেকদিন পর হঠাৎ আজ ভীষণ হালকা লাগছে নিজেকে, সেটাও লাগত না। যদিও যেসব ঘটনার কথা বললাম, সেগুলোর থেকে হাজার গুণ গুরুত্বপূর্ণ অনেক অনেক ঘটনা আমার জীবনে আছে- তবু এগুলোও আমার অতীত, যে অতীতটা আমি আর কোনোদিন ফিরে পাবো না। সেই অতীতের আমি'র তখনকার অনেক অনূভুতিই মরে গ্যাছে, অনূভুতিগুলো যার ছিলো সে নিজেও অনেকবার মরেছে। অনেক কিছুই মলিন হয়ে গ্যাছে দিন দিন, অনেক গানের সুর, অনেক কবিতার গন্ধ। এসব কথা সেসব কথা ভাবতে গেলে এখন ক্যাবল মনে হয়, "কত আগের কথা, হাউ লঙ্গ অ্যাগো!"
তসলিমা নাসরিনের একটা কবিতার কিছু লাইনও মনে বেজে ওঠে-
"জীবন এভাবেই ফুরিয়ে যেতে থাকে
আর আমরা দিন দিন একা হয়ে যেতে থাকি।
.......যখন ধু ধু ... ধুলোয় চোখ বুজে আসে,
ফেলে আসা যৌবনের কথা ভাবি,
বড় অচেনা লাগে সেইসব দিন, যেন আমি নই,
অন্য কেউ, অন্য কারও জীবন ছিলো আমার জীবন।......
......আমার সমুদ্র নেই, সাঁতার শিখিনি কোনওদিন, সুখ বলে যা কিছুই ছিলো
পুরোনো ফুলের মতো টুপটাপ ঝরে গেছে, অথবা উড়ে গেছে বিক্ষুব্ধ হাওয়ায়।......
....স্মৃতির কণাগুলো শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এক ঝাঁক রাজহাঁস
আমাকে বলতে বলতে যায়,
যে জীবন আমি যাপন করে গেছি এতকাল,
সে জীবন আসলে আমার ছিলো না।...."
আঠারো বছরের একটা ছেলে "ফেলে আসা যৌবনের" কথা ভাবছে, তার জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে- এ'ধরনের কথা শুনে অনেকেই রে রে করে উঠবেন। কেউ বলবেন "জীবন তো এখনো শুরুই হয়নি", কেউ বলবেন "কৈশোর সবে পার করছ, আর বলছ যৌবন ফেলে এসেছো?"; কেউ বলবেন "কি সেন্টিমেন্টাল সব কচকচি!"; কেউ বলবেন "থাক, ছেলেটা ছেলেমানুষ। ওকে রেহাই দে।" কেউ কেউ আবার স্বান্তনা দিতে বলবেন "অতীত কারোরই ফেরে না। দেখবে, তোমার অতীতে তুমি যাদের ভালোবেসেছ, তার চেয়েও বেশি ভালো তুমি ভবিষ্যতে অন্য কারুকে বাসতে পারবে।"
যে যা খুশি বলে বলুক। আমি আগেই বলেছি, আমার নিজেরটুকু আমি জানলেই যথেষ্ট। যেটা আর কেউ বুঝবে না, সেটা আর কাউকে বোঝাতেও চাই না। সেটা আমার একার জন্যই রইল।
ব্রাত্যদা ভালো থাকুন, রাওয়ানদি'র সাথে সুখে থাকুন- সেই কামনা সবসময়ই আছে। ব্রাত্যদা যদি এরপরও মনে করে থাকেন আমি মিথ্যে বলেছি, তবে শেষবারের মতো বলি- যতটুকু সম্ভব সত্য আমি সবসময়ই বলার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে যখন মিথ্যে বলতে হয়, পারতপক্ষে কথাটা আমি এড়িয়ে যাই- মিথ্যে বলার থেকে বাঁচতে। তবু মাঝে
মাঝে কিছু মিথ্যে আমাকেও বলতে হয়। নাস্তিকতা, নারীবাদ, তসলিমা নাসরিনের মতো বিষয় নিয়ে লড়াই করলে মাঝে মাঝে না বলে উপায় থাকে না। হাজার হোক, আমি
তো আর তসলিমা নাসরিন নই। তাঁর মতো অকপট সত্য বলার সাহস আমার নেই। আমার জীবনের "কালি, কাঁটা, অন্ধকারগুলো" আমাকে তাই লুকিয়েই রাখতে হয়। তবু
যতদূর আমি পারি, ততদূর সত্য বলে যাই।
রবি ঠাকুরের একটা কবিতা দিয়ে শেষ করা যাক। আমার এই পুরো লেখাটার সারটুকু তো বটেই, আমার জীবনের সারকথাও এই কবিতাটায় ধরা আছে-
এ মুখের পানে চাহিয়া রয়েছ কেন গো অমন করে?
তুমি চিনিতে নারিবে, বুঝিতে নারিবে মোরে।
আমি কেঁদেছি হেসেছি, ভালো যে বেসেছি এসেছি যেতেছি সরে
কী জানি কিসের ঘোরে।
কোথা হতে এত বেদনা বহিয়া এসেছে পরান মম।
বিধাতার এক অর্থবিহীন প্রলাপবচন-সম।
প্রতিদিন যারা আছে সুখে দুখে আমি তাহাদের নই--
আমি এসেছি নিমেষে, যাইব নিমেষ বই।
আমি আমারে চিনি নে, তোমারে জানি নে, আমার আলয় কই!
জগৎ বেড়িয়া নিয়মের পাশ, অনিয়ম শুধু আমি।
বাসা বেঁধে আছে কাছে কাছে সবে,
কত কাজ করে কত কলরবে,
চিরকাল ধরে দিবস চলিছে দিবসের অনুগামী-
শুধু আমি নিজবেগ সামালিতে নারি ছুটেছি দিবসযামী।
প্রতিদিন বহে মৃদু সমীরণ, প্রতিদিন ফুটে ফুল।
ঝড় শুধু আসে ক্ষণেকের তরে সৃজনের এক ভুল-
দুরন্ত সাধ কাতর বেদনা ফুকারিয়া উভরায়
আঁধার হইতে আঁধারে ছুটিয়া যায়।
এ আবেগ নিয়ে কার কাছে যাব, নিতে কে পারিবে মোরে!
কে আমারে পারে আঁকড়ি রাখিতে দুখানি বাহুর ডোরে!
আমি কেবল কাতর গীত!
কেহ বা শুনিয়া ঘুমায় নিশীথে, কেহ জাগে চমকিত।
কত-যে বেদনা সে কেহ বোঝে না, কত-যে আকুল আশা,
কত-যে তীব্র পিপাসাকাতর ভাষা।
ওগো তোমরা জগৎবাসী,
তোমাদের আছে বরষ বরষ দরশ-পরশ-রাশি--
আমার কেবল একটি নিমেষ, তারি তরে ধেয়ে আসি।
মহাসুন্দর একটি নিমেষ ফুটেছে কাননশেষে,
আমি তারি পানে ধাই, ছিঁড়ে নিতে চাই,
ব্যাকুল বাসনা-সংগীত গাই
অসীমকালের আঁধার হইতে বাহির হইয়া এসে।
শুধু একটি মুখের এক নিমেষের একটি মধুর কথা,
তারি তরে বহি চিরদিবসের চিরমনোব্যাকুলতা।
কালের কাননে নিমেষ লুটিয়া কে জানে চলেছি কোথা!
ওগো, মিটে না তাহাতে মিটে না প্রাণের ব্যথা।
অধিক সময় নাই।
ঝড়ের জীবন ছুটে চলে যায় শুধু কেঁদে "চাই চাই"--
যার কাছে আসি তার কাছে শুধু হাহাকার রেখে যাই।
ওগো, তবে থাক্, যে যায় সে যাক- তোমরা দিয়ো না ধরা।
আমি চলে যাব ত্বরা।
মোরে কেহ কোরো ভয়, কেহ কোরো ঘৃণা, ক্ষমা কোরো যদি পারো!
বিস্মিত চোখে ক্ষণেক চাহিয়া তার পরে পথ ছাড়ো!
তার পরদিনে উঠিবে প্রভাত, ফুটিবে কুসুম কত,
নিয়মে চলিবে নিখিল জগৎ প্রতিদিবসের মতো।
কোথাকার এই শৃঙ্খল-ছেঁড়া সৃষ্টি-ছাড়া এ ব্যথা
কাঁদিয়া কাঁদিয়া গাহিয়া গাহিয়া,
অজানা আঁধার-সাগর বাহিয়া,
মিশায়ে যাইবে কোথা!
এক রজনীর প্রহরের মাঝে ফুরাবে সকল কথা।
৩টি মন্তব্য:
সাধারণত বড় ল্যাখা খুব এ্যাকটা পড়ি না। স্বগোক্তি বলুন আর কষ্টই বলুন ল্যাখাটি চমৎকার গোছালো। জানি এ ল্যাখা গোছানো না ভাল তা খুব এ্যাকটা আপনার কাছে গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়। ভাল থাকুন।
change the template and color.
u got a nice hand,
i like ur style
kishor d gupta
ধন্যবাদ অর্ণবদা, এত বড় ল্যাখাটা ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য। আপনার কমেন্টটা আমার মনটাই ভালো করে দিলো।
আর কিশোরদা, থ্যাঙ্কস টু ইয়ু ঠু। আমি টেমপ্লেট বদলাবো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন